ইরান থেকে বার্মা (মিয়ানমার) পর্যন্ত বিস্তৃত ভারত বিভক্তির ক্ষেত্রে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র উন্মাদনাপূর্ণ অর্জন কী উপমহাদেশের মুসলমানদের রক্ষা অথবা ধ্বংস করেছিল? ভারত বিভাগকে জিন্নাহ সবসময় প্রকাশ্যে এতোটা জোরের সঙ্গে বলতেন যেন দেশবিভাগই মুসলিম মুক্তির সমার্থক, কিন্তু একান্তে তিনি কখনও নিশ্চিত ছিলেন না যে, প্রকৃত অর্থে পাকিস্তান বলতে কী বোঝায়। সেজন্য তিনি কখনও তাঁর কল্পিত দেশটির ভৌগোলিক কাঠামো অথবা আদর্শকে সংজ্ঞায়িত করেননি, যা কোনো জাতি-রাষ্ট্রের দুটি অত্যাবশ্যকীয় দিক। তাঁর নীতিকথা উৎকীর্ণ ছিল মর্মর পাথরে: যা তিনি কখনও ব্যাখ্যা করেননি, সবসময় অভিযোগ করেছেন।

ভারতের শেষ দ্বিতীয় ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল এবং তাঁর উত্তরসূরী লর্ড মাউন্টব্যাটেন বার বার জিন্নাহকে বলেছেন তার পরিকল্পনা সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য। কিন্তু একটি যৌক্তিক উত্তর দেওয়া থেকে প্রতিবার তিনি নিজেকে বের করে নিয়েছেন। যে কারণে হতাশ মাউন্টব্যাটেন অনেকটা বাধ্য হয়েই তাঁকে ‘মানসিক অস্থিরতা সম্পন্ন’ (psychopathic case) বলে উল্লেখ করেছিলেন। মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে একাধিকবার বলেছেন যে, ‘অখন্ড ভারত হবে সবচেয়ে অগ্রসর একক সত্তা’ এবং ‘বিপুল শক্তির অধিকারী এবং বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে সামনের সারিতে থাকবে।’ কিন্তু মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের ১১ এপ্রিল লিখেছেন, “জিন্নাহ পাল্টা কোনো যুক্তি দেননি। তিনি এমন ভাব প্রদর্শন করেন যে তিনি শুনছেন না। তাঁর সঙ্গে যুক্তিতর্ক করা অসম্ভব ছিল — মি: জিন্নাহ ‘মানসিক অস্থিরতা সম্পন্ন’ ছিলেন। তিনি যাই বলে থাকুন না কেন তার মগ্নতা ছিল পাকিস্তান নিয়ে — যার একমাত্র ফলশ্রুতি হতে পারে অনিবার্যভাবে মুসলমানদের অপূরনীয় ক্ষতি সাধন।”

মাউন্টব্যাটেন পুরোপুরি সঠিক ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির কারণে উপমহাদেশের মুসলমানদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। জিন্নাহ’র একমাত্র অর্জন ছিল ভারতীয় মুসলমানদের তিনটি দেশে বিভক্ত করা, একটি শক্তিশালী, গণতান্ত্রিক, বহু-ধর্মীয়, বহুজাতিক এবং অখন্ড ভারতে বেগবান চালিকাশক্তি হিসেবে তাদের সম্ভাব্য ভূমিকা পালনের সুযোগ ধ্বংস করা। জিন্নাহ’র সবচেয়ে সেরা সাফল্য ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
ইশতিয়াক আহমেদ “জিন্নাহ: হিজ সাকসেসেস, ফেইল্যুরস এণ্ড রোল ইন হিস্টোরি” নামে তাঁর চমৎকার, বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত গ্রন্থের প্রতিপাদ্য জিন্নাহ’র সাফল্য, ব্যর্থতা ও ইতিহাসে তাঁর স্থান — এই তিনটি বিতর্ককে নমনীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির পর জিন্নাহ’র মনে সন্দেহের উদয় সম্পর্কে তিনি একাধিকবার ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বেশ কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন, যাতে বোঝা যায় যে জিন্নাহ বিজয়ীর অনুশোচনায় ভুগছিলেন, এবং তা এমন পর্যায়ে ছিল যে, তিনি পাকিস্তানকে বর্ণনা করেছেন তাঁর “সবচেয়ে বড় ভুল” হিসেবে।

জিন্নাহ তাঁর যুক্তিতে অনমনীয় ছিলেন যে মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে এক জাতি হিসেবে থাকতে পারে না; উপমহাদেশের ইতিহাস অথবা ভূগোলে এর কোনো ভিত্তি ছিল না। জিন্নাহ তাঁর প্রস্তাবিত পাকিস্তানে সীমানা সংক্রান্ত কোনো ব্যাখ্যা দেননি, কারণ তাঁর মূল যুক্তিই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি ভাষা এবং অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভারতীয় মুসলমানদের একটি অবিচ্ছিন্ন ও সংলগ্ন স্থানে আবাসনের ব্যবস্থা করার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু অদৃষ্টের কী পরিহাস, ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ইউনিয়নিস্ট পার্টি কর্তৃক শাসিত পাঞ্জাব এক সমসাময়িক অকাট্য প্রমাণ ছিল যে, জিন্নাহ’র তত্ত্ব ছিল সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ। মুসলিম ও শিখরা শুধু একত্রে বসবাস করেনি, বরং প্রমাণ করেছিল যে একটি মিশ্র জোটের পক্ষেও কীভাবে সমতা ও ভারসাম্য বজায় রেখে শাসন পরিচালনা করা সম্ভব।

ভারতের দুই পাশে অবস্থিত দুটি অংশ নিয়ে সৃষ্ট জিন্নাহ’র পাকিস্তান অদ্ভুত এক ঘটনা ছিল, যেন মস্তকবিহীন দুটি দেহ। কারণ বাঙালিরা, যারা এখন বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে, তারা শীঘ্র উপলব্ধি করেছিল যে পাকিস্তানের যে শুধু মাথা নেই তা নয়, হৃদপিণ্ডও নেই। খ্যাতিমান আইনবিদ এমসি চাগলা, যিনি তাঁর তরুণ বয়সে জিন্নাহ’র চেম্বারে কাজ করেছেন, একবার তিনি জিন্নাহকে উকিল হিসেবে বিচরক্ষণ, কিন্তু আইনজীবী হিসেবে বেচারা গোছের বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা ছিল, জিন্নাহ একটি মামলার ভিত্তি বা গুরুত্বের ওপর সামান্য বিবেচনা করেই জিন্নাহ চমৎকারভাবে যুক্তি দিতে পারতেন।

জিন্নাহ’র জীবন ছিল বৈপরীত্যের এক অভিধান। এর মধ্যে ধর্ম ছিল প্রান্তিক বিষয়। আদর্শিক কোনো বোধের চেয়ে তিনি বরং নামেমাত্র বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নামাজ পড়তেন শুধু মাঝেমধ্যে, তাও রাজনৈতিক কারণে, আধ্যাত্মিক কারণে নয়। রমজান মাসে তিনি কখনও রোজা রাখতেন না অথবা ইসলামের খাদ্যবিধি পালন করতেন না। তিনি যদিও ব্যাপক ভ্রমণ করেছেন, কিন্তু কখনও হজ্ব পালনের জন্য মক্কায় যাওয়ার কথা চিন্তা করেননি। একটি ঐতিহ্যবাহী গুজরাটি শিয়া মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী জিন্নাহ’র মধ্যে তাঁর তারুণ্যে অত্যন্ত সুস্পষ্ট শিষ্টাচারের বিকাশ ঘটেছিল। তাঁর আদব-কায়দা ছিল ব্রিটিশ; তাঁর আচরণ ছিল অভিজাতসুলভ — তিনি এমনকি তাঁর আহরিত শ্রেনির নিচের লোকজনকে স্পর্শ করতেও অপছন্দ করতেন, যা একজন রাজনীতিবিদের জন্য চমকে ওঠার মত ভীতি ছিল। কিন্তু তাঁর রাজনীতি আঁকড়ে ধরা ছিল দৃঢ় এবং প্রতিপক্ষের দুর্বলতা সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন ছিল তীব্র। একজন ব্যক্তি, যিনি জানতেন সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে, তাঁর একগুঁয়েমি সহজাত আত্মবিশ্বাসকে প্রবল করে তুলেছিল তাঁর জীবনের শেষ এবং সবচেয়ে নাটকীয় বছরগুলোতে।

জিন্নাহ অন্তত ১৯৪০ সাল থেকেই জানতেন যে তাঁর অবিরাম ধূমপানজনিত কারণে না হলেও ফুসফুসের ব্যাধি তাঁর জীবনকে বিনাশ করে ফেলছে। তাঁর জীবনের গত সাতটি বছর ধরে তাঁর ডাক্তাররা যা জানতেন তিনি নিজেও তার জানতেন যে যক্ষা ব্যাধি ইতিহাস গ্রন্থে তাঁর প্রবেশের স্বপ্নে আগ্রাসী হয়ে এসেছে। তাঁর অপ্রিয় মোহনদাস গান্ধীর ভারতের মহাত্মা এবং বিশ্বের তারকা হয়ে ওঠতে দেখে তিনি নি:সন্দেহে যাতনা ভোগ করছিলেন।

জিন্নাহ’র জীবনের শেষ ধাপ শুরু হয়েছিল ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে যখন তিনি লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে যাওয়ার পথে দিল্লিতে, যে অধিবেশনে তিনি প্রথম পাকিস্তানের দাবী উত্থাপন করেন। বোম্বে থেকে যাত্রা করার পর ট্রেনে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, কিন্তু দিল্লিতে তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক ছিল, যা তিনি বাতিল করতে পারেননি। ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোর (Lord Linlithgow) সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ নির্ধারিত ছিল। ব্রিটিশ কী চাইছিল জিন্নাহ’র তা জানা ছিল এবং তিনি বড় ধরনের একটি দরকষাকষির প্রস্তাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের চাপে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। গান্ধী ব্রিটিশকে যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু তাঁর পুরস্কার হিসেবে অবিলম্বে ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। এর বিপরীতে জিন্নাহ এমন এক সময়ে ভাইসরয় লিনলিথগোকে পরিপূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন যখন ব্রিটেন অন্ধকার সময় পার করছিল। বিনিময়ে তিনি সুস্পষ্ট ব্রিটিশ প্রতিশ্রুতি লাভ করেন: যুদ্ধের পর ভারতের জন্য যেকোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থাই করা হোক না কেন মুসলিম লীগের স্বীকৃত নেতা হিসেবে তাতে জিন্নাহ’র ভেটো দেওয়ার অধিকার থাকবে। এটি ‘আগস্ট প্রস্তাব’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, কারণ লিনলিথগো ১৯৪০ সালের আগস্ট মাসে এ সম্পর্কে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন। জিন্নাহ ব্রিটিশকে সমর্থন করেন এবং তাদের যুদ্ধ জয়ের জন্য অপেক্ষা করেন।

ইশতিয়াক আহমেদ তাঁর গ্রন্থে নিশ্চিত করেছেন যে ব্রিটিশ রাজে জিন্নাহ’র অনুপ্রবেশকারী হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না; তিনি চার্চিলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এ কারণে ১৯৪২ সালে ক্রিপস মিশন এবং ১৯৪৬ সালে কেবিনেট মিশনের সঙ্গে কঠিন আলোচনার সময়েও তাঁর ব্যতিক্রমী আত্মবিশ্বাসকে অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়েছিল। জিন্নাহ নিশ্চিত ছিলেন যে লন্ডন তাদের আশ্বাসের মর্যাদা দেবে। ১৯৪৭ সালের পর জিন্নাহ যখন মন্তব্য করেন যে তিনি ও তাঁর স্টেনোগ্রাফার পাকিস্তান সৃষ্টি করেছেন তখন তাঁর কথার যথার্থতা বোঝা যায়। মুসলিম লীগ ছিল সুবিধা হাসিলের একটি উপকরণ, বাস্তবে কোনো রাজনৈতিক শক্তি নয়।

ঘটনাবলী যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালের মধ্যে জিন্নাহ’র সিদ্ধান্ত দুটি বিকল্পের মধ্যে একটিতে সীমাবদ্ধ হয়, যদি তিনি অখণ্ড ভারতের কাঠামোর মধ্যে মুসলমানদের সংহত করার প্রস্তাব গ্রহণ করেন তাহলে ভারত এক দেশ ও এক জাতি হিসেবে থাকবে; আর তিনি যদি পৃথক আবাসভূমির ওপর জোর দেওয়া অব্যাহত রাখেন তাহলে পাকিস্তানের অনুমোদন দেওয়া হবে। কিছুসংখ্যক সৎ ব্রিটিশ নেতা জিন্নাহকে তাঁর আবেগ থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। ব্রিটেন নিজেদেরকে দোষমুক্ত করে। পাকিস্তানের ওপর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুসলমানদের উচ্চ রাজনৈতিক পুরোধাগণ এবং সমর্থিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল দ্বারা।

এই যৌক্তিকতা ছিল একটি ভ্রান্ত ধারণা বা মোহ, যাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। ব্রিটিশ ভারতের গণতন্ত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ভোটাধিকার সীমিত ছিল দেশবাসীর মধ্যে মাত্র ১০ অথবা ১১ শতাংশ সুবিধাভোগীর কাছে, যাদের কর পরিশোধ করার সামর্থ ছিল। ভারতীয় মুসলমানদের নয়-দশমাংশই পাকিস্তানের ওপর ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তাছাড়া ভোটকে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর নামে সাম্প্রদায়িক করে ফেলা হয়েছিল, যে ব্যবস্থায় মুসলমানরা শুধু মুসলমান প্রার্থীদের ভোট দিতে পারতো, যা বিভক্তিমূল ও অর্থহীন আবেগের সৃষ্টি করেছিল।
ইশতিয়াক আহমেদ ব্রিটিশ রাজের কৌশলকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, “জিন্নাহর প্রতি ব্রিটিশ উৎসাহ ও সমর্থন তাঁকে এমন জনপ্রিয় বাগড়ম্বরের দিকে নিয়ে যায় যে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পৃথিবীতে এক মুসলিম স্বর্গের প্রতিশ্রুতি দিতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর মূল ও সম্পুরক যুক্তি এবং রাজনৈতিক কৌশলের লক্ষ্য ছিল ভারতকে বিভক্ত করা।

জিন্নাহর দাবীকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের শর্তে অনুমোদন করে। তাদের ওপর নির্ভরশীল জিন্নাহ যখনই কোথাও ভুল করেছেন ব্রিটিশ তাকে পিচ্ছিল পথ থেকে পুনরায় বাস্তবতায় ফিরিয়ে এনেছে। শুধু একটি বিষয়ে জিন্নাহকে দ্বিধাগ্রস্থ মনে হয়েছিল যখন ১৯৪৬ সালের জুন মাসে কেবিনেট মিশন ব্রিটিশ প্রত্যাহারের পরিকল্পনা ঘোষণা করে যে তারা ভারতকে অখণ্ড অবস্থায় রেখে বিদায় নেবে। উদ্বিগ্ন জিন্নাহ ব্রিটিশ শর্তকে উত্তম বিবেচনা করে তা মেনে নেওয়ার কথা জানান। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ভারতব্যাপী আনন্দ-উচ্ছাস বয়ে যায়। কিন্তু এরপরই চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। জওহরলাল নেহরুকে সদ্য কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তিনি বোম্বেতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিবৃতি দিয়ে বসেন যে কংগ্রেসের দ্বারা কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়টি তিনি মানেন না।

এদিকে জিন্নাহ কর্তৃক পাকিস্তানের দাবী পরিত্যাগ করার ঘোষণায় মুসলিম লীগের কট্টরপন্থীরা তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন এবং নেহরুর বিবৃতিকে কংগ্রেসের চিরাচরিত প্রতারণার কৌশল বলে নিন্দা জানান। জিন্নাহ তিক্ততার সঙ্গে উল্লেখ করেন যে ব্রিটিশের উপস্থিতিতেই কংগ্রেস যদি তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে এতো দ্রুত এভাবে সরে আসতে পারে, সেক্ষেত্রে ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করার পর কীভাবে তাদেরকে বিশ্বাস করা সম্ভব? জিন্নাহ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ এর আহবান জানান, যা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দেয় এবং কোনো ধরনের সৌহার্দ্যপূর্ণ নিস্পত্তির সকল সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়।

কলকাতায় ১৯৪৬ সালের ১৬ ও ১৮ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত ভয়াবহ দাঙ্গায় কমপক্ষে তিন হাজার নিহত এবং ১৭ হাজারের অধিক মানুষ আহত হয়। কলকাতার দাঙ্গা সম্পর্কে ইশতিয়াক আহমেদ তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ব্রিটিশ সরকার দাঙ্গার ঘটনায় জিন্নাহ, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দি অথবা মুসলিম লীগের অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, অথচ অতীতে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বা আইন অমান্য আন্দোলন আহবান করার কারণে গান্ধী, নেহরু, মাওলানা আজাদ, বল্লভভাই প্যাটেল, আবদুল গাফফার খানকে গ্রেফতার করার ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটিশের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে যে বিশৃঙ্খলা অঙ্কুরেই দমন করা সম্ভব ছিল, তারা নিস্পৃহ থাকায় দাঙ্গা কলকাতা থেকে দ্রুত ভারতের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

আহমেদের মতে পাকিস্তান আন্দোলনের বিবর্তনে সংহিংসতা রূপান্তরের ভূমিকা পালন করে। তিনি লিখেছেন, “কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সর্বণাশা প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বছরের পর বছর ধরে চলে আসা বিবাদের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা ভারতজুড়ে এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল।

কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পূর্ণ তাৎপর্য ও বিপর্যয়কর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী, যা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃতভাবে মানুষের মনস্তত্বে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছিল এবং হিন্দু ও শিখদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তুলেছিল। এর আগেও ১৯২০ এর দশক থেকে উপমহাদেশে হিন্দু, মুসলিম ও শিখদের মধ্যে ধর্মীয় পুনর্জাগরণ আন্দোলনের সময় ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নিয়েছিল, কিন্তু তা কখনও ব্যাপকভিত্তিক সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা হিসেবে দেখা দেয়নি, যা ঘটেছে ভারতের বিভক্তিকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা ও পাঞ্জাবে সংঘটিত দাঙ্গায় নজীরবিহীন হত্যা, লুণ্ঠন ও বাড়িঘর জ্বালানোর ঘটনা ঘটেছে। ওই সময়ের ঘটনাগুলো প্রতিশোধ স্পৃহার কারণে ঘটলেও সংগঠিত ও পরিকল্পিত আক্রমণের ঘটনা শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সালের দ্বিতীয় অর্ধাংশ থেকে এবং সাতচল্লিশের মধ্য আগস্টে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় বিভক্ত পাঞ্জাবের উভয় পাশে যারা ক্ষমতায় এসেছিল সেই প্রশাসনের সম্পৃক্ততায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পাঞ্জাবেই প্রথম জাতিগত নির্মূলের অভিযান সূচিত হয়েছিল।

পাকিস্তানের প্রকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছিল ১৯৪৫ সালে সুলতানকোটে মুসলিম লীগ অধিবেশনে পরিবেশিত সঙ্গীতে, যা ছিল নিম্নরূপ:
“পাকিস্তান হোক ইসলামের পৃথক এক কেন্দ্র,
পাকিস্তানে আমাদেরকে কোনো অমুসলিমের মুখ দেখতে হবে না,
মুসলিম জাতির আবাস তখনই উজ্জ্বল হয়ে ওঠবে,
যখন পাকিস্তানে কোনো মূর্তিপূজারির কন্টক থাকবে না।”
পরিহাসের বিষয় হলো, জিন্নাহ যদি সহিংসতা দ্বারা গজানো ভ্রান্ত এক বেহেশতের জাদুকরী অঙ্কুরের উদগম ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি বাঙালি মুসলমানদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অস্বীকার করার মাধ্যমে পাকিস্তানকে ধ্বংসের বীজও রোপন করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নিহিত ছিল জিন্নাহ কর্তৃৃক বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করার মধ্যে।

পাকিস্তানের ধারণার ভঙ্গুরতা সম্পর্কে জিন্নাহ সবসময় সচেতন ছিলেন, তিনি জানতেন যে জাতীয় নীতির মধ্যে বাংলাকে অন্তর্ভূক্ত করা হলে পাকিস্তান দুর্বল হবে। জিন্নাহ সর্বাংশে ইংলিশ-প্রেমিক ছিলেন, তার ধারণা ছিল না যে ভারতীয়রা তাদের বিভিন্ন ভাষার প্রতি গভীর আবেগ পোষণ করে এবং ভাষাগত সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। সেজন্য তিনি ‘প্রাদেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড অভিযান শুরু করেছিলেন। করাচি বার এসোসিয়েশনে বক্তৃতা দানকালে তিনি বলেন, “আমি চাই মুসলমানরা প্রাদেশিকতাবাদের ব্যাধি থেকে মুক্ত হোক। তার ভীতির কারণ ছিল বাংলা।

জিন্নাহ এবং মদ্যপায়ী নওয়াব লিয়াকত আলী খানসহ তাঁর উত্তরসূরীরাও মনে করতেন যে পাকিস্তানের ধারণার মধ্যে যে ঘাটতিগুলো রয়েছে তা দূর করার জন্য ইসলামকে বন্ধন সৃষ্টির একটি সুসংহত উপাদানে রূপান্তরিত করতে হবে। এটি তাদের নির্বুদ্ধিতা ছিল। ইসলাম আল্লাহর নাজিলকৃত বিশ্বজনীন এক বিশ্বাস। আল্লাহ হচ্ছেন, ‘রাব্বুল আলামিন’ — বিশ্বের প্রভু। ইসলামকে জাতীয়তাবাদের কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ করা যায় না। যে নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে জাতি গড়ে ওঠে তা মসজিদে প্রাযোজ্য নীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। জিন্নাহর ব্যক্তিগত জীবনাচরণ এবং জনসমক্ষে তাঁর বক্তব্য থেকে তাঁর স্ববিরোধিতা স্পষ্ট হয়েছে যে তিনি ইসলামকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। ব্রিটিশ শাসনের বিশেষ পরিস্থিতিতে জিন্নাহ তাঁর মর্জি অনুযায়ী পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলেন, যার বিপর্যয়কর খেসারত দিতে হচ্ছে প্রজন্ম পরম্পরায়।